
প্রকাশিত: Fri, Dec 8, 2023 10:10 PM আপডেট: Mon, Jun 23, 2025 8:35 PM
মানবিক ভাড়াটিয়া
জারিন তাসনিম : মহিলা ওয়ার্ডের প্রথম বিছানায় শুয়ে আছেন মালতী। বয়স ৩৫। দুপুর থেকে ব্যাথায় কাতরাচ্ছেন, সাথে প্রচণ্ড জ্বর। গ্রাম থেকে আসা সব রোগীর অ্যাটেন্ডেন্ট মূলত তিন প্রকার। একজন থাকে প্রধান অ্যাটেন্ডেন্ট, তার দায়িত্ব স্কুলের হেডমাস্টারের মতো। এরপর প্রধান সহকারী ও সহকারী অ্যাটেন্ডেন্ট। সহকারী অ্যাটেন্ডেন্ট, মানে সেকেন্ড অ্যাসিসটেন্টের কাজ মূলত স্কুলের আয়াদের মতো। এটা ওইটা আনা জাতীয় ফিজিক্যাল ওয়ার্ক। শহর থেকে আসা রোগীদের ব্যাপার আলাদা। তারা শিফটিং ডিউটি করে। প্রতি শিফটে নতুন মানুষ আসে, পুরোনো কথা নতুন মানুষদের নতুন করে বুঝিয়ে বলতে হয়। মালতীর কথা বলছিলাম।
মালতীর স্বামী এবং বাবা হাসপাতালে থাকলেও প্রধান অ্যাটেন্ডেন্ট হিসেবে তাকে দেখাশোনা করার গুরু দায়িত্ব লাভ করেছে তার আট বছর বয়সী কন্যা। কন্যার নাম জানি না। শ্যামলা মুখ, ছোটো ছোটো চোখ, পাতলা শরীর, কাঁধ সমান স্ট্রেইট চুল, সেই চুলের নিচ দিয়ে আবার একটু বাঁকা কার্ল। এ ধরনের কার্ল সাধারণত ধনী কিংবা ফ্যাশনেবল মেয়েদের ছোটোখাটো পার্টিতে যাবার আগে করতে দেখা যায়। এই মেয়েটি নিতান্ত দরিদ্র ঘরের সন্তান। এই স্টাইল সে জন্মগত পেয়েছে। মেয়েটি হলুদ রঙের ময়লা জামা পড়ে ঘুরছে। খুব সম্ভবত সে তিনদিন ধরে একই জামা পড়ে আছে। হাতের আঙুলের নখে লাল রঙা নেইলপলিশের অবশিষ্টাংশ রয়ে গেছে। অযত্নে বড় হওয়া নখের নিচে উঁকি দিচ্ছে ময়লা। তার কাজকর্মের ধরণ বেশ গোছানো এবং গম্ভীর।
একটু পর পর সে ব্যস্ত হয়ে ডাক্তারের রুমে আসে। ‘আন্টি, আম্মুর জ্বর ১০৩, কাঠি (সাপোজিটরি) দিবো?’ ‘দিয়ে দাও’। ‘এখন তো বমি করতেছে। একটু দেখেন না’। হাতের কাজ শেষ করে যেতে যেতে মালতীর বমি থেমে যায়। মেয়েটি তখন ব্যস্ত ভঙ্গিতে মায়ের প্রস্রাবের ব্যাগ ফাঁকা করছে। দুটি নতুন ইনজেকশন ফার্মেসি থেকে কিনে আনা লাগবে। হাসপাতালে সাপ্লাই শেষ। তাকে ওষুধের নাম কাগজে লিখে দেওয়া হয়েছে। ডিউটিতে যাবার পর থেকে আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ মেয়েটির দিকে। তার প্রতিটি কর্মকাণ্ড দর্শনীয়। কখনো সরাসরি, কখনো আড় চোখে তাকে আমি দেখছি।
একটু পর দেখি ওষুধের লিস্ট নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বের হচ্ছে। জানতে চাইলাম, ‘কোথায় যাও’? ‘ওষুধ আনতে’। ‘তোমার লোক কই’? ‘ফার্মেসির সামনে। আমার জন্য দাঁড়ায়া আছে...’ মেয়েটি নিচে চলে গেলো। চারতলা থেকে নিচতলা, সেখান থেকে অনেক টুকু হেঁটে বিশাল দুই মেইন রোড পার হয়ে ফার্মেসি। তার সাথে কোনো মোবাইল ফোন নেই, গুগল ম্যাপ নেই, পরিচিত কোনো মানুষ নেই, এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা, এই হাসপাতালের অলি গলির সঙ্গে তার পূর্ব পরিচিতি নেই। অথচ সে এমনভাবে হেঁটে চলছে, যেন এটি তার বাড়ির উঠান। উঠান থেকে সে কেবল গোঁয়াল ঘরে যাচ্ছে। একটু পর একজন লোক এবং ওষুধ নিয়ে শিশু কন্যা ফেরত আসলো। তাকে ফেরত পেয়ে আমি খুশি হই। উঠে দেখতে যাই নেহাৎ কৌতূহল থেকে। সাদা চুল, চামড়া কুঁচকে যাওয়া বয়স্ক একজন মানুষ মেয়েটির সাথে দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে ময়লা সাদা শার্ট যার রং ইতোমধ্যে ধূসর। লুঙ্গিটি স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচুতে বাঁধা। মেয়েটি তখন মায়ের জ্বর মাপছে। বৃদ্ধ লোক তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে নীরব দর্শক। তার জীর্ণশীর্ণ মুখের অসহায় দৃষ্টি নজর এড়ায় না।
আমিই আইস ব্রেক করি। ‘আপনার মেয়ে?’ লোকটি হালকা হেসে উত্তর দেয়, ‘বাড়িওয়ালী’ আমি বুঝতে পারি না। আবার জিজ্ঞেস করি, ‘বাড়িওয়ালী?’ ‘জ্বি’ এমন মানবিক ভাড়াটিয়া এখনও বেঁচে আছে ভেবে অবাক লাগে। এই ব্যাপারে চিন্তা করতে করতে অন্যদিকে পা বাড়াই। কিন্তু আমার হিসাব মেলে না। চার কদম এগিয়ে আবার পিছাই। জিজ্ঞেস করি, ‘উনার স্বামী আসে নাই’? ‘আমিই স্বামী,’ লোকটি লজ্জা মিশ্রিত হাসে আর বলে। লোকটির ছলছল চোখ প্রথমবারের মতো চোখে পড়ে। আমি লজ্জা পাই, কষ্ট পাই, ঈর্ষান্বিত হই। ৫ ডিসেম্বর, ২০২৩। ফেসবুক থেকে
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
